জিপিএস কি
Global positioning system |
অতিতে অবস্থান নির্ণয়ের জন্য নানা রকম ঝামেলা পোহাতে হতো। মানচিত্র কম্পাস স্কেল দিয়ে নেফিউ সঠিক অবস্থান বের করাটা ছিল একপ্রকার অসাধ্য। অথচ বর্তমানে আমাদের হাতে থাকা স্মার্টফোন কি দিয়ে কাজটি খুব সহজেই করা যায়।
আর তার জন্য যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় জিপিএস GPS বা global positioning system।জিপিএস এর বাংলা অর্থ হচ্ছে 'বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণয় ব্যবস্থা'।
GPS এর পূর্নরুপ কি
GPS এর পূর্নরুপ হচ্ছে Global positioning system
বর্তমানকালের আধুনিক বিশ্ব যে কতটা জিপিএস নির্ভর তা হয়তো আমরা ভেবেও দেখিনি। তাই আজকের এই পোস্টে আমরা '' জিপিএস কি?'' এবং ''জিপিএস কিভাবে কাজ করে?'' এসম্পর্কিত সকল প্রশ্নের উত্তর জেনে যাব।
GPS কেন আবিষ্কার করা হয়
GPS প্রযুক্তি আবিষ্কার করা হয়েছিল মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রয়োজনে। প্রথমদিকে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্র গুলোতে জিপিএস ব্যবহার করা হলেও পরবর্তীতে সাধারণ মানুষই বেশি এর দ্বারা লাভবিত হয়েছে।
GPS কিভাবে কাজ করে
এই ব্যবস্থায় মূলত কতগুলো স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যে সমগ্র পৃথিবীতে পর্যবেক্ষণ করে গ্রাহককে সুবিধামতো তার অবস্থান জানানো হয়।
সহজ করে বলতে গেলে মনে করুন আপনি কোথাও বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন। এখন আপনাকে বলা হলো আপনি ঢাকা থেকে 320 কিলোমিটার দূরে আছেন। কিন্তু ঢাকা থেকে কোন দিকে 320 কিলোমিটার পূর্ব-পশ্চিম নাকি উত্তর-দক্ষিণ কিছুই আপনার জানা নেই।
এরপর আপনাকে বলা হলো আপনি চিটাগং থেকে 150 কিলোমিটার দূরে আছেন। তারপরেও কিন্তু আপনার অবস্থান বোঝা সহজ হলো না।
কিন্তু এরপর যদি বলা হয় আপনি কক্সবাজার থেকে 95 কিলোমিটার দূরে আছেন তখন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে। কারণ এই তিন জায়গার দূরত্ব যে বিন্দুতে ছেদ করে আপনি নিশ্চয়ই সেখানে আছেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে আপনি ঢাকা চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার থেকে উল্লেখিত দূরত্বে বান্দরবানে আছেন। এভাবে হিসাব করাকে বলা হয় Trilateration. স্যাটেলাইট ব্যবহার করে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ এবং উচ্চতা এই তিনটি বিষয়ে জানার মাধ্যমে কোন স্থানের যথার্থ অবস্থান নির্ণয় করা যায়।
তিনটি স্থানে সম্মিলিত বিন্দুকে কে বলা হয় Coordinate point. পৃথিবীর দুটি জায়গার নাম একই হতে পারে কিন্তু তাদের Coordinate point পয়েন্ট কখনোই একি হতে পারে না। এ কারণেই স্যাটেলাইট এর সাহায্যে নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করা যায়।
জিপিএস কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়
সমগ্র পৃথিবী কে জিপিএস ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে ত্রিশটি স্যাটেলাইট সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে। তবে এই সেবা নিশ্চিত করতে চব্বিশটি স্যাটেলাইট এর দরকার হয়। একটি স্যাটেলাইট হঠাৎ করে নষ্ট হয়ে গেলে জিপিএস ব্যবস্থা যেন বিঘ্নিত না হয় সেজন্য বাকি ছয়টি স্যাটেলাইট ব্যাকআপ রাখা হয়েছে।
জিপিএস স্যাটেলাইটগুলো এমনভাবে সাজানো যেকোনো মুহূর্তে পৃথিবীর যে কোন জায়গার অবস্থান নির্ণয় করতে চারটি স্যাটেলাইট সব সময় থাকবেই। তার মানে এই মুহূর্তেও আপনি কমপক্ষে চারটি জিপিএস স্যাটেলাইট এর আওতায় আছেন।
স্যাটেলাইটের অবস্থান কোথায় বা স্যাটেলাইট গুলো মহাকাশের কোথায় থাকে
এসব স্যাটেলাইট পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় 20 হাজার কিলোমিটার উচ্চতায় ঘুরতে থাকে। একেকটি জিপিএস স্যাটেলাইট পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে আসতে 12 ঘন্টা সময় নেয়। অর্থাৎ এরা দিনে দুইবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।
স্যাটেলাইট সব সময় এক ধরনের রেডিও সিগন্যাল বা সংকেত পাঠাতে থাকে। পৃথিবীতে থাকা জিপিএস চিপস বা সেন্সর সিগন্যাল গ্রহণ করে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়।
বর্তমানকালে প্রায় সকল স্মার্টফোনেই জিপিএস চিপস বা সেন্সর আছে। স্মার্টফোন ছাড়াও আজকাল স্মার্ট ঘড়ি চাবির রিং জুতা নানান ধরনের সরঞ্জামে জিপিএস চিপস এর ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।স্যাটেলাইট সিগন্যাল পাঠায় এবং জিপিএস চিপস সিগন্যাল গ্রহণ করে।
জিপিএস এর মাধ্যমে কিভাবে অবস্থান নির্ণয় করা যায়
জিপিএস GPS কিভাবে অবস্থান নির্ণয় করে এ বিষয়টি বুঝার আগে আপনাকে সিগন্যাল আদান-প্রদান করার বিষয়টা বুঝতে হবে। স্যাটেলাইট যখন সিগন্যাল পাঠায় এবং রিসিভার যখন সিগন্যাল গ্রহণ করে সেই দুটি সময়ের লিপিবদ্ধ করা হয়।
সিগন্যাল প্রেরণের এবং সিগন্যাল গ্রহণ এর মধ্যবর্তী এই সময় দিয়েই দূরত্ব পরিমাপ করা হয়। এসব রেডিও সিগন্যাল সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ সময়ে তিন কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে।
তারমানে স্যাটেলাইট থেকে আপনার স্মার্টফোনে সিগন্যাল আস্তে এক সেকেন্ডেরও কম সময় লাগে। অতি ক্ষুদ্র এই সময়ের ব্যবধান নির্ণয় করা হয় এটমিক ক্লক বা আণবিক ঘরির সাহায্যে।
অ্যাটোমিক ক্লক বা আণবিক ঘড়ি কি
অ্যাটোমিক ক্লক বা আণবিক ঘড়ি হলো সময় নির্ণয়ের জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে নির্ভুল যন্ত্র। এসব ঘড়ি এক সেকেন্ডের কোটি ভাগ সময়ও নির্ণয় করতে পারে। রিসিভারের সাধারণত এমন এটমিক ক্লক থাকেনা। এগুলো শুধুমাত্র স্যাটেলাইট সংযুক্ত থাকে।
আন্টি স্যাটেলাইট থেকে যখন একটি রিসিভারের দূরত্ব জানা যায় তখনই জিপিএসের মাধ্যমে নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
গুগল ম্যাপ কিভাবে অবস্থান নির্ণয় করে
জিপিএস স্যাটেলাইট বা রিসিভার যে অবস্থান নির্ণয় করে আমরা সাধারন মানুষ তা সহজেই বুঝতে পারবো না। কারণ জিপিএস শুধু কোঅর্ডিনেট পয়েন্ট চিহ্নিত করে। আর গুগল ম্যাপ এর মত সফটওয়্যার গুলো সেই পয়েন্ট কে বিভিন্ন জায়গার নাম দিয়ে আমাদের কাছে সহজভাবে উপস্থাপন করে। কিভাবে মূলত গুগল ম্যাপ আমাদের অবস্থান নির্ণয় করে থাকে।
আমেরিকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ১৯৭০ এর দশকে জিপিএস পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তাদের এই স্যাটেলাইট ব্যবস্থার NAVSTAR GPS । হাজার 978 প্রথম NAVSTAR স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠানো হয়। জিপিএস ব্যবস্থা কার্যকর করতে 989 সাল থেকে 24 টি স্যাটেলাইট ব্যবহার শুরু হয়েছে।
জিপিএস সিস্টেম কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়
জিপিএস সমগ্র ব্যবস্থা দেখাশোনার জন্য পৃথিবীতে মোট তিরিশটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে হারিয়ে যাওয়া সনদের খুঁজে বের করতে কিংবা দূর থেকে নির্ভুলভাবে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো সহ সামরিক প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহার করাই ছিল এই পরিকল্পের মূল উদ্দেশ্য।
হাজার 995 সালে সেবাটি বিনামূল্যে জনসাধারণের সেবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। তবে জিপিসি একমাত্র গ্লোবাল নেভিগেশন সিস্টেম নয়। যেহেতু এই প্রযুক্তির যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মালিকানাধীন। তাই তাদের চির প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া নিজেদের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। যার নাম gloves glonass বা global navigation satellite system। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের জি এন এস এস চীনের Beidou এবং ভারতের navic প্রায় একই ধরনের কাজ করে।
তবে সমগ্র বিশ্বের সিংহভাগ ডিভাইস এ আমেরিকার জিপিএস চিপস থাকার কারণে এখনো পর্যন্ত এর প্রতিদ্বন্দী কেউ নেই বললেই চলে।
বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং ঘরে বসে খাবার অর্ডার করা কিংবা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাপের মাধ্যমে লেনদেন করার মতো বহু জরুরি কাজে আমরা জিপিএস ব্যবহার করছি। কিন্তু এর বাইরেও যে জিপিএসের কত গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার আছে তা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা।
সমগ্র বিশ্বের ব্যাংকিং লেনদেন, স্টকমার্কেট,বিদ্যুৎ গ্রিড ডিজিটাল টেলিভিশন স্টেশন এর মত অবকাঠামো জিপিএস এর উপর নির্ভরশীল। জিপিএস ছাড়া আধুনিক বিশ্বের যোগাযোগব্যবস্থা কল্পনাই করা যায় না। সামরিক বিমান থেকে শুরু করে সাধারণ যাত্রীবাহী বিমান এবং সমুদ্রগামী জাহাজ গুলো জিপিএস ব্যবহার করেই আকাশে কিংবা মহাসাগরে পথ চিনে নেয়।
আধুনিক এই জিপিএস ব্যবস্থা আসার পর থেকে দুর্ঘটনা ব্যতীত কোন বিমান বা জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার খবর নেই বললেই চলে এমনকি এই ব্যবস্থায় আপনি চাইলেও হারিয়ে যেতে পারবেন না।
1996 সাল থেকে মোটর গাড়িতে জিপিএস এর ব্যবহার শুরু হয়েছে এর ফলে সড়ক পথে পণ্য পরিবহন কোম্পানিগুলো তাদের মালামাল এই মুহূর্তে কোথায় আছে তার সার্বক্ষণিক নজরদারি করতে পারছে এছাড়া জিপিএস ব্যবহারের ফলে বিশ্বব্যাপী গাড়ি চুরি ঠেকানোর আছে উল্লেখযোগ্য হারে।